পেঁয়াজের উৎপাদন প্রযুক্তি

পেঁয়াজের উৎপাদন প্রযুক্তি

মাটি ও আবহাওয়া

     দোআঁশ ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হালকা দোআঁশ বা পলিযুক্ত মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম। মাটি উর্বর এবং সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রচুর দিনের আলো, সহনশীল তাপমাত্রা ও মাটিতে প্রয়োজনীয় রস থাকলে পেঁয়াজের ফলন খুব ভাল হয়। রবি পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ১৫-২৫ সে. তাপমাত্রা পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য উপযোগী। ছোট অবস্থায় যখন শেকড় ও পাতা বাড়তে থাকে তখন ১৫ সে. তাপমাত্রায় ৯-১০ ঘন্টা দিনের আলো থাকলে পেঁয়াজের  বাল্ব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তীতে ১০-১২ ঘন্টা দিনের আলা ও ২১ সে. তাপমাত্রা এবং গড় আর্দ্রতা দ৭০ শতাংশ থাকলে পেঁয়াজের কন্দ ভালভাবে  বাড়ে, বীজ গঠিত হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। মাটির পিএইচ ৫.৮ তেকে ৬.৫ হলে পেঁয়াজের ফলন ভাল হয়। সমুদ্র তীর থেকে ২১০০ মিটার উচ্চ পাবর্ত্য উপত্যকাতেও পেঁয়াজের চাষ করা যায়। হালকা মাটিতে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগে পেঁয়াজের ফলণ ভাল হয়। অধিক ক্ষার বা অম্ল মাটিতে পেঁয়াজের আকার ছোট হয় ও পুষ্ট হতে বেশী সময় লাগে।

জমি তৈরি ও চারা রোপণ

     গভীর চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। পেঁয়াজের জমি চাষের জন্য ডিস্কহ্যারো ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ এতে মাটি পুনরায় শক্ত হয়ে যায়। আগাছামুক্ত ঝুরঝুরা সমতল মাটি পেঁয়াজের জন্য উত্তম। সারি থেকে সারি দূরত্ব ৩০ সেমি এবং পেঁয়াজ থেকে পেঁয়াজের দূরত্ব ১৩-১৫ সেমি রাখতে হবে।

বপন/রোপণ পদ্ধতি ও সময়

     সরাসরি জমিতে বীজ বুনে, কন্দ ও চারা রোপণ করে পেঁয়াজ উৎপাদন করা যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতুতে অর্থাৎ রবি ও খরিপ মৌসুমে এমনকি সারা বছরের ফসলরূপে পেঁয়াজের চাষ হয়। দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বীজতলায় বীজ বুনে, চারা তুলে সেই চারা জমিতে রোপণ করা হয়। সরাসরি ছোট ছোট কন্দ লাগিয়েও পেঁয়াজের চাষ করা হয়। সাধারণত অক্টোবর থেকে নভেম্বর (আশ্বিন-কার্তিক) মাসে বীজতলায় বীজ বোনা হয় এবং ৪০-৫৫ দিন পর চারা জমিতে রোপণ করা হয়। সমগ্র উত্তরাঞ্চল, যশোর, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর অঞ্চলে সারা বছল ধরে গ্রীষ্মকালিন পেঁয়াজের চাষ করা হয়। গ্রীষ্মকালে ফেব্রম্নয়ারি থেকে জুলাই এবং বর্ষাকালে জুলাই থেকে অক্টোবর এবং শীতকালে অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসে পিঁয়াজ চাষ করা যায়।

বীজ বপনঃ

বীজের পরিমাণ প্রতি হেক্টরে ৩-৪ কেজি। অপরদিকে সরাসরি জমিতে বীজ বুনে পেঁয়াজ চাষে হেক্টরপ্রতি প্রায় ৬-৭ কেজি বীজের প্রয়োজন হবে। কন্দের আকার ভেদে হেক্টরপ্রতি প্রায় ১.২-১.৫ টন কন্দের প্রয়োজন। বীজ বপনের পূর্বে প্রতি কেজি বীজের সাথে ২ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম যেমন বেভিস্টিন মিশিয়ে বীজ শোধন করা যায়।বীজতলার  উপর ১০ সেমি পুরু করে খড় বিছিয়ে আগুন জ্বালিয়ে বীজতলা শোধন করা যেতে পারে। বীজতলা ৩X১ মি. আকারে হতে হবে। প্রতি বীজতলায় ২৫-৩০ গ্রাম হিসেবে বুনতে হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে চারা উৎপাদনের জন্য ৩X১ মি. আকারে ১২০-১৩০টি বীজতলার প্রয়োজন হবে। বীজ বুনে, ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে ১ সেমি পুরু করে ঢেকে দিতে হবে। এবং তারপর প্রয়োজন অনুসারে ১-২ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। বোনার প্রায় ৫-৭ দিন পর বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা বের হয়ে আসে। চারা ছোট অবস্থায় বীজতলায় প্রচুর আগাছা জন্মো এবং উক্ত আগাছাসহ পরিষ্কার করে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। বীজ বপণের ৪০-৪৫ দিন পর চারা যখন ১৫-২০ সেমি উঁচু হয় তখনই তা জমিতে রোপণের উপযুক্ত হয়।

সারের  পরিমাণ (রবি)

রবি মৌসুমে পেঁয়াজ চাষে নিমণরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।

সারের নাম

পরিমান

গোবর

৮-১০ টন

ইউরিয়া

২৫০-২৭০ কেজি

টিএসপি

১৯০-২১০ কেজি

এমওপি

১৫০-১৭০ কেজি

সার প্রয়োগ পদ্ধতি

     শেষ চাষের  সময় সবটুকু গোবর বা কম্পোস্ট, টিএসপি এবং ইউরিয়া ও এমপি সারের অর্ধেক জমিতে সমানভাবে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি সমান অংশে যথাক্রমে চারা রোপণের ২৫- ৫০ দিন পর ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। কন্দ বা সরাসরি বীজ বপন করে চাষ করার ক্ষেত্রেও মোটামুটিভাবে এ নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।

 

সারের পরিমাণ ও সার প্রয়োগ পদ্ধতি (খরিফ)

     হালকা দোআঁশ মাটিতে উপযুক্ত জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে চাষ করলে পিয়াজ বেশ বড় ও ভারী হয় এবং সেগুলো অনেকদিন সংরক্ষণ করা যায়। খরিফ পেঁয়াজ চাষে নিম্নরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।

সারের নাম

পরিমান

শেষ চাষের সময়

উপরি প্রয়োগ

১ম কিস্তি

২য় কিস্তি

৩য় কিস্তি

গোবর

৭ টন

সব

-

-

-

ইউরিয়া

২৬০ কেজি

-

৮৭কেজি

৮৬কেজি

৮৭কেজি

টিএসপি

২২০ কেজি

সব

-

-

-

এমওপি

১৮০ কেজি

-

১০০কেজি

 

১০০কেজি

জিপসাম

১৮০ কেজি

সব

-

-

-

পিএইচ-এর মাত্রা ৩ এর নিচে হলে চুন প্রয়োগ করতে হবে। কারণ নিমণমাত্রার পিএইচ দ্বারা উৎপাদন মৌসুমে পুষ্টির অভাবজনিত লক্ষণ প্রকাশ পায়। পেঁয়াজ উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে যদি পিএইচ এর অপর্যপ্ততা দেখা দেয় তাহলে পুষ্টিজনিত অভাবের কারণে ফলন কম হবে। জমি প্রস্ত্তত করা ২-৩ দিন পূর্বে পরিমাণ মত চুন প্রয়োগ করতে হবে।

     শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি ও জিপসাম সমান ভাবে ছিটিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া ও অর্ধেক এমপি চারা রোপণের ১৫ দিন পর, এক তৃতীয়াং ইউরিয়া ২৫-৩৫ দিন পর এবং বাকি এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া ও অর্ধেক এমপি ৪৫-৫৫ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে। মাটি শুকনা হলে ও প্রয়োজনীয় রস না থাকলে সারের উপরি প্রয়োগের পরপরই হালকা সেচ দিতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা

প্রাথমিক অবস্থায় ২-৩ বার নিড়ানি দিয়ে জমি আলগা করে আগাছা মুক্ত করতে হবে।পেঁয়াজের কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফুলের করি দৃষ্টিগোচন হওয়া মাত্রই তা ভেঙ্গে দিতে হবে।পেঁয়াজের জমিতে মাটির প্রয়োজনীয় রস না থাকলে প্রতি ১০-১৫ দিন অন্তর পানি সেচ প্রয়োজন।শীতকালিন ফসলের তুলনায় গ্রীষ্মকালিন ফসলে বেশি সেচের প্রয়োজন হয়।   পেঁয়াজ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সুতরাং পেঁয়াজের জমিতে পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবেকন্দ গঠিত হয়ে গেলে সেচ কম লাগে এবং পেঁয়ারেজ বাল্ব পরিপক্ক  ও সংগ্রহের এক মাস পূর্বে সেচ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিত এবং না করলে গুণাগুণ ও সংরক্ষণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। পেঁয়াজ ফসল দীর্ঘদিন সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলে এবং হঠাৎ করে  সেচ দিলে কন্দের শল্কপত্র ফেঁটে যেতে পারে এবং বাজার  মূল্য দারম্নভাবে কমে যেতে পারে। তাই সব সময় যেন জমিতে জো থাকে সে ব্যবস্থা করা দরকার।

অন্যান্য পরিচর্যা

ছত্রাক রোগ দমন

     গাছের বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে রোভরাল  প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম এবং রিডোমিল প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করে গাছ ভিজিয়ে দিতে হবে। এর পর ১৫ দিন অন্তর বীজ দানা বাধা পর্যন্ত উক্ত ছত্রাকনাশক কয়েকবার স্প্রে করতে হবে। স্টেমফাইলাম ছত্রাকের আক্রমণ না থাকলে প্রথম স্প্রে করার পর পরবর্তীতে শুধু রোভরাল স্প্রে করলেই চলবে। এভাবে রোগ দমন করে প্রতি হেক্টরে ১২০০ কেজি বীজ উৎপাদন সম্ভব।

সুত্রঃ ডিএই ওয়েবসাইট